তকমার রাজনীতি
- আপলোড সময় : ২৬-১২-২০২৪ ০৯:০৯:০৬ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-১২-২০২৪ ০৯:০৯:০৬ পূর্বাহ্ন
আমীন আল রশীদ::
আওয়ামী লীগের আমলে সরকারের সমালোচক বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যেভাবে রাজাকার, বিএনপি-জামায়াত এমনকি জঙ্গি তকমা দেয়া হয়েছে, একইভাবে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কারো কোনো বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকার বা তাদের অংশীজনদের সমালোচনামূলক হলে তাকে বলা হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর বা আওয়ামী লীগের দালাল। বলা হচ্ছে: ‘এতদিন কোথায় ছিলেন!’ অর্থাৎ এতদিন কেন সমালোচনা করেননি।
শুধু রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নয়, নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক সমস্যা যেমন ঢাকার রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম, নিত্যপণ্যের দাম বেশি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি - এসব নিয়েও কেউ যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় রাগ-ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন- তাকে তার পরিচিতজনরাই এসে প্রশ্ন করছেন, আপনার আপার আমলে কি ঢাকায় জ্যাম হতো না? আগে কি জিনিসপত্রের দাম কম ছিল? আগে কী গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা ছিল না? ইত্যাদি। তার মানে, আগে যা যা হয়েছে, তা এখন হতে অসুবিধা নেই বা আগে হয়েছে বলে এখনও সেটা হওয়া জায়েজ!
সম্প্রতি বগুড়া ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই কর্মীর হাতকড়া পরে বাবার জানাজায় অংশ নেয়ার ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়। এর মধ্যে একজন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-স¤পাদক গোলাম রব্বানী। বাবার জানাজায় অংশ নিতে তাকে তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন আদালত। এরপর পুলিশি পাহারায় তিনি বাবার জানাজায় অংশ নেন। এসময় তার এক হাতে হাতকড়া ছিল। তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেয় পুলিশ। আরেকজন রাজশাহীর বাঘা আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল কালাম আজাদ। তাকেও বাবার জানাজায় অংশ নিতে তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয় এবং তিনিও হাতকড়া পরা অবস্থাতেই জানাজায় অংশ নেন- যে ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে।
এ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। বলেছেন অপরাধী যত বড়ই হোক, অন্তত নামাজের সময় হাতকড়া খুলে ফেলা যেত। যেহেতু আসামির দুই পাশে পুলিশ ছিলই, অতএব জানাজার নামাজ থেকে আসামি পালিয়ে চলে যাবে, সেটি খুব সহজ নয়। বস্তুত মানুষ বিষয়টিকে মানবাধিকার ও নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ও বলার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে পুলিশের যুক্তিও আছে। যেমন তারা মনে করেছেন যে, হাতকড়া না থাকলে আসামির পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে মামলা, মামলায় আসামি করা, অজ্ঞাত আসামির ফাঁদে ফেলে পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য, জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত ও কারাগারে রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্নের অন্ত নেই। এর প্রতিটি বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর ধরে সমালোচনা চলছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বগুড়া জেলা কারাগারে এক মাসে চার আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। যদিও পুলিশ বলছে, চারজনই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ধরা যাক, ওই চারজন সত্যিই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। প্রশ্ন হলো, তাদের কি আগে থেকেই হার্টের অসুখ ছিল নাকি ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন?
দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এইসব ঘটনা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুললে বা সমালোচনা করলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমালের ঘটনাবলি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং যিনি বা যারা এইসব প্রশ্ন তুলছেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে আওয়ামী লীগের দালাল বা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসর বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এখন আসামির হাতকড়া পরা অবস্থায় জানাজায় অংশ নেয়া কিংবা নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাসহ আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে যা হয়েছে, সে তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকারের গত চার মাসে যথেষ্ট কম হয়েছে। বরং এমনও অনেক বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটেছে, যা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। প্রশ্ন হলো, আগে ঘটেছে বলে এখনও একইরকম ঘটনা ঘটলে তার সমালোচনা করা যাবে না বা সমালোচনা করলেই সেটিকে সরকারবিরোধিতা বা আওয়ামী লীগের দালালি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে কেন?
একজন নাগরিক যেকোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে কিছু লিখলে সবা বললেই তাকে একটি রাজনৈতিক দল বা মতের দিকে ঠেলে দেয়ার এই প্রবণতাটি আগের সরকারের আমলেই শুরু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হবে কবে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খুব সাধারণ প্রবণতা ছিল যে সরকারের কোনো রাজনৈতিক সমালোচনা করলেই তিনি বিএনপি-জামায়াত-রাজাকার। উন্নয়ন প্রকল্পের সমালোচনা করলেই তিনি উন্নয়নবিরোধী, সরকারবিরোধী এমনকি রাষ্ট্রবিরোধী। অর্থাৎ একটি পরিবার, দল, সরকার ও দেশকে একাকার করে ফেলার মধ্য দিয়ে পুরো জাতিকে স্পষ্টত দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে- যেই বিভক্তির রাজনীতি এখনও চলমান। বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং আগে একপক্ষ ট্যাগিংয়ের রাজনীতি করতো, এখন করে আরেক পক্ষ।
কারা ট্যাগিং করেন? :
যারা অন্যকে এই ধরনের ট্যাগ দেন তারা সরাসরি সরকারের অংশ নন। অর্থাৎ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা বা অন্য কোনো পদের জনকর্মচারী নন। অনেক সময় হয়তো তারা সরকারি দলীয় নেতাকর্মীও নন। কিন্তু তারা নিজেদেরকে সরকারের অংশ মনে করেন। সেটি তারা নানা কারণেই মনে করেন। হতে পারে সরকার ও সরকারসংশ্লিষ্টদের সুনজরে থাকা এবং তার বিনিময়ে কোনো না কোনো ব্যক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করা। সেটি হতে পারে তার কর্মস্থলের নিরাপত্তা, ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা পাওয়ার পথ খোলা রাখা এমনকি কেউ কেউ এই ধরনের ট্যাগিংয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে সরকারও সরকারসংশ্লিষ্টদের ঘনিষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টা করে তাদের অতীতের কোনো অপরাধমূলক বা বিতর্কিত কর্মকা- আড়াল করার জন্য। কেউ কেউ এটা করেন নিতান্তই পেশাগত ঈর্ষা ও ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ থেকেও।
যে কারণে আওয়ামী লীগের আমলে যে-রকম সব সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি গ্রুপ খুব সক্রিয় ছিল যারা সরকার ও দলের সকল কাজের জাস্টিফিকেশন তথা জায়েজিকরণে ভূমিকা রাখতো। অর্থাৎ সরকার বা ক্ষমতাসীন দল কোনো খারাপ বা গণবিরোধী কাজ করলেও সেটিকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করা; কেউ ওই কাজের সমালোচনা করলে সাথে সাথে তাকে সরকারবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী, জঙ্গি ও জামায়াত বলে তকমা লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন যাতে তিনি ভয় পান এবং সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে ভবিষ্যতের এই ধরনের কথা না বলেন বা এইসব ইস্যুতে প্রতিবাদ না করেন। এর মধ্য দিয়ে শুধু ওই সমালোচনাকারীকেই নয়, বরং বাকিদেরকেও এই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হতো যে, আপনিও যদি এই বিষয়ে সমালোচনা করেন তাহলে একইভাবে আপনাকে রাজাকার বলা হতে পারে।
কেন ট্যাগিং? :
এর মধ্য দিয়ে মূলত মূলত কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাওয়া হয়। ১. সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সমস্ত কাজকে প্রশ্নাতীত তথা আনচ্যালেঞ্জড রাখা। ২. কেউ যাতে সমালোচনা করে ওই কাজটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, সেজন্য এক ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। ৩. ভবিষ্যতেও তাকে এবং অন্যকে সমালোচনা করা থেকে বিরত রাখা। অর্থাৎ মনের ভেতরে এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ ঢুকিয়ে দেয়া। ৪. ট্যাগিং বা তকমা দেয়ার সঙ্গে জড়িত থেকে নিজেদেরকে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে প্রমাণ করা।
এই একই কাজ এখনও হচ্ছে। সরকারের কোনো সমালোচনা এমনকি কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা বা তীর্যক মন্তব্য করলেও তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে।
সবাই কি আপনার ভাষায় কথা বলবে? :
মুশকিল হলো, প্রত্যেকেই চায় পৃথিবীর সকল মানুষ তার মতো করে ভাববে, বলবে ও লিখবে। তা তো হয় না। প্রত্যেকের চিন্তা, মত ও মতবাদ, আদর্শ, ভাষা ও বলার ভঙ্গি আলাদা। এটিই চিরন্তন সত্য এবং মানবজাতির এই বৈচিত্র্যই তাকে অন্য প্রাণিদের সঙ্গে আলাদা করেছে। সুতরাং একই বিষয়ে দশজন মানুষের দেখা, বলা ও লেখার ভঙ্গি যদি দশরকমেরও হয়, সেটিও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার এই বলা ও লেখার কারণে কোনো একটি রাজনৈতিক দলে ঠেলে দেয়াটা বিপজ্জনক।
আওয়ামী লীগের আমলে কাউকে রাজাকার বলে গালি দিলে বা তকমা দিলে একজন দলনিরপেক্ষ মানুষের জন্য সেটি যে ধরনের সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক বিপদ ডেকে আনতো, একইভাবে এখন কাউকে আওয়ামী লীগ, লীগের দোসর বা ফ্যাসিবাদী বলে তকমা দিলে একইরকমের বিপদের শঙ্কা তৈরি হয়। বিশেষ করে যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যারা সরাসরি কোনো দলের কর্মী নন।
সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার মানুষের সংখ্যা যখন সমাজ থেকে ক্রমশই কমে যাচ্ছে এবং নানা কারণেই মানুষের মধ্যে যখন দলবাজ ও দলদাস হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, তখন শুধু প্রশ্ন করা বা সমালোচনার কারণে তাকে আগের মতোই কোনো না কোনো ট্যাগ দিয়ে তাকে ডিমোরালাইজড করে দেয়ার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কেননা সমাজে এই ধরনের ট্যাগিং চলতে থাকলে একটা পর্যায়ে গিয়ে আর কথা বলার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটা সমাজে মানুষ শুধুই ক্ষমতার তোষণ করবে, প্রশংসা করবে, আপাই সঠিক কিংবা স্যার যা ভালো মনে করেন - এই ধরনের প্রবণতা সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। বস্তুত ক্ষমতাসীনদের প্রতিটি কাজকে আনচ্যালেঞ্জড রাখা বা প্রশ্নাতীত রাখার চেষ্টা করলে সেটি আখেরে ওই সরকারের জন্যই বিপদ ডেকে আনে। কেননা প্রশ্ন ও জবাবদিহিহীন সরকার দ্রুতই স্বৈরাচারে পরিণত হয় এবং যখনই কোনো শাসক ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচার হয়ে ওঠে তখন স্বভাবতই ভেতরে ভেতরে সে জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং মানুষ সুযোগ পেলেই তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। অতীতের এইসব অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানের শাসক ও তাদের অংশীজনরা শিক্ষা নিতে না পারলে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই যে একটা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে, সেটি আরও একবার ভূলুণ্ঠিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ